বিশ্ব ব্যানার্জি/নদীয়া:- ব্রেনের পিটুইটারি গ্ল্যান্ডে দুইবার হয়ে গিয়েছে অস্ত্রোপচার। আর তার ফলাফল হিসেবে ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি ৮৫ ভাগ হারিয়েছেন এবং বাঁ দিকের চোখেরও চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিয়েছেন আর মেরে কেটে দু থেকে আড়াই বছর। তবুও জীবন যুদ্ধে থেমে থাকেন নি তিনি। নদিয়ার কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা মন্দিরা আচার্য। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। পেয়েছিলেন ন্যাশনাল স্কলারশিপ, ভর্তি হয়েছিলেন পিএইচডিতেও! স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়ার! তবে কিছু ঘটনা ঘুরিয়ে দেয় তার জীবনের মোড়!
কলেজে পড়াকালীন হঠাৎই দেখা দেয় সেই দুরারোগ্য রোগ। ধরা পড়ে ব্রেনের পিটুইটারি গ্ল্যান্ডের রোগ! এরপর করা হয় ভিন রাজ্য থেকে অপারেশন। তবে সুফল মেলেনি তাতে। কয়েক মাস সুস্থ থাকলেও আবারও একই সমস্যা ফিরে আসে। পরে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে জানতে পারেন প্রথম অস্ত্রোপচার ভুল করা হয়েছে। সুতরাং দ্বিতীয় বার পুনরায় অপারেশন। তবে চিকিৎসকেরা বলে দিয়েছিলেন এই অস্ত্রপ্চারের ফলে হয়তো তিনি কখনও তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন না এমনকি চলে যেতে পারে তার স্মৃতিশক্তিও। এরপর খানিক জমে মানুষের টানাটানি!
সফলভাবে অস্ত্রোপচারের পর প্রায় দুদিন পরে ফিরে ছিল তার জ্ঞান। তবে স্মৃতিশক্তি তার চলে না গেলেও সেই প্রভাব পড়েছে চোখের উপর। অস্ত্রোপচারের পর দীর্ঘ চার বছর ছিলেন বিছানায় শয্যাশায়ী! ধীরে ধীরে তিনি হারাচ্ছেন দৃষ্টিশক্তি। তবে হয়তো মনের শক্তি তার শারীরিক শক্তির থেকে অনেক বেশি প্রবল। আর সেই কারণেই শত বাঁধা পেরিয়েও আজ তিনি সকলের “মামনি”!
বর্তমানে তিনি ও তার ভাই একটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তবে তাদের পরিচিতি এখানেই শেষ নয়। কৃষ্ণনগর থানার অন্তর্গত ভূতপাড়া নামক একটি আদিবাসী পাড়ায় সকালবেলা নিয়মিত তিনি যান আদিবাসী পাড়ার প্রায় ২৫০ জন ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের দুধ বিস্কুট খাওয়াতে। এভাবেই চলে আসছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। প্রায়শই দেখা যায় এই সমস্ত পাড়ার ছেলে মেয়েরা থাকে কিছুটা অবহেলিত। অনেক সময় সঠিক পুষ্টির অভাবে হয় তারা অপুষ্টির শিকার। তাদের কথা ভেবেই প্রতিদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে চলে যান আদিবাসী পাড়ার বাচ্চাদের দুধ বিস্কুট খাওয়াতে।
মন্দিরা দেবী জানান, “মনের জোরই আসল, আমার বিশ্বাস যে মানুষ চলে কিন্তু মনের জোরে। হয়তো স্বপ্ন অনেক কিছু ছিল আমার। তবে মাঝখানে এতকিছু ঘটে যাওয়ার পরেও আমি ভয় পাই না। কারণ আমি একটা কথাই জানি মানুষ চলে মনের জোরে। এইসব শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আমার কাছে কিছুই না। কারণ আমাকে অনেক কাজ করতে হবে অনেকের জন্য কাজ করতে হবে এবং তাদের জন্য ঠিক থাকতে হবে। এটাই আমার জীবনের মূল লক্ষ্য!”
প্রতিদিন সকালবেলা স্কুলে যাওয়ার আগে আদিবাসী পাড়ায় তিনি বাচ্চাদের যান দুধ বিস্কুট খাওয়াতে। এরপর স্কুল থেকে ফিরে এসে কৃষ্ণনগর স্টেশনে ভবঘুরেদের জন্য প্রতিদিন রান্না করেন তিনি। তারই মাঝে সময় করে করতে হয় সমস্ত রান্নার সরঞ্জাম এবং বাজার। এরপর সবশেষে কিছুটা সময় তিনি বার করেন তার ছেলের জন্য। ঘরে বাইরে সব মিলিয়ে তার এখন অনেক বড় সংসার! নিজের দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে হারালেও তিনি তার কাজের বলে সকলের “নয়নের মনি”।