অনেকটা নিজের সত্তার মধ্যেই লুকোনো আরেকটা সত্তা। যাদের প্রকৃতি অনেকটাই ভিন্নধর্মী। আবার কখনও তাঁরা মিলেমিশে এক হয়ে যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে মনের প্রবৃত্তির এক জটিল অবস্থার নাম ‘বাইপোলার ডিসওর্ডার’ বা ‘বাইপোলার মুড ডিসওর্ডার’ (Bipolar disorder)। যাকে ‘ম্যানিক ডিপ্রেসন’ (Manic Depression) বলে থাকেন চিকিৎসকরা। অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের ক্ষেত্রে ঠিক তেমনই হচ্ছিল। প্রথমবার সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখ খুলে এমনটাই জানিয়েছেন, অভিনেতার চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট ডক্টর সুজান মোফাট ওয়াকার। অর্থাৎ তীব্র মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন সুশান্ত। বাইপোলার ডিসঅর্ডারের পাশাপাশি হাইপোম্যানিয়াতেও ভুগছিলেন তিনি। যে রোগের উপসর্গ হল প্রবল মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা। চিকিৎসকদের কথায়, এই অবস্থায় অনেক রোগীই নিজেদের ঠিক রাখতে পারেন না। এই প্রচন্ড মানসিক চাপ সহ্য করতে পারেন না।
সুশান্তের মানসিক চিকিৎসক সুজানের দাবি, ‘বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার’ যাদের হয় তারা তীব্র উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগে ভোগেন। সবসময়েই একটা মানসিক চাপ থাকে যেটা কাটিয়ে উঠতে পারেন না রোগী। সুশান্তের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই হয়েছিল। মানসিক স্থিতি একদমই ঠিক ছিলনা সুশান্তের। এই পরিস্থিতিতে কোনও রোগী, কখনও হাসিখুশি আবার কখনও তীব্র মানসিক যন্ত্রনা অনুভব করেন। একটা দ্বৈত সত্তার জন্ম হয় রোগীদের মনে। ফলে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী আচরণ লক্ষ্য করা যায় রোগীদের মধ্যে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অবস্থায় মেজাজ শূন্য থেকে একশোর মধ্যে ঘোরাফেরা করে। কখনও ভাল তো কখনও একদম খারাপ। রোগীেদের মনে হতে থাকে সে অন্য একটা মানুষ। সম্পূর্ণ অন্য চরিত্র নিয়ে বাঁচছে। সেই মতো কাজ করতে শুরু করে সে। ফলে আচরণেও অনেকটা বদল আসে।এমনকি কথা বলার ধরণও বদলে যায় অনেক ক্ষেত্রে। একেই বলা হয় দ্বৈত সত্তা। এই বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভোগা রোগীদের ক্ষেত্রে একটা খারাপ দিক হল, আচমকাই তীব্র মানসিক অবসাদে চলে যাওয়া। মনের মধ্যে রাগ, দু:খ, ঘৃণা একসঙ্গেই জেগে ওঠা। আবার অনেকের ক্ষেত্রে প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে ওঠে। আবার আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতাও এই ক্ষেত্রে বেশি। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভোগা রোগীদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মনে হয় তাঁদের জীবনের সব আশা শেষ, তিনি মুখ থুবড়ে পড়েছেন। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় আত্মহত্যা করেছেন রোগী।
কখন হয় এই বাইপোলার ডিসঅর্ডার?
এই ধরণের পরিস্থিতি যে কোনও সময়ই আসতে পারে। তবে বয়:সন্ধিকালে এই ধরণের প্রবল মানসিক চাপ থেকে বাইপোলার ডিসঅর্ডার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, মস্তিষ্কের সেরাটোনিন ও ডোপামিন হরমোনের বেশি ক্ষরণ হলে মানুষ অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আর এই অবস্থারই চরম পরিস্থিতি হল বাইপোলার ডিসঅর্ডার। তাঁদের মতে এই ধরণের অসুখ ক্ষণস্থায়ী, আবার কখনও কখনও দীর্ঘদিন ধরেই চলতে দেখা গিয়েছে এই পরিস্থিতি। সেক্ষেত্রে রোগী সুস্থ হয়েও বিপরীতমুখী আচরণে অভ্যস্থ হয়ে উঠতে দেখা গিয়েছে। তখন তিনি সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষ।
বাইপোলার ডিসঅর্ডার ও হাইপোম্যানিয়া
হাইপোম্যানিয়া হল হাল্কা মাত্রার ম্যানিয়া। যেখানে মন-মেজাজ এবং আচার-আচরণের অস্বাভাবিকতা খুবই ঘনঘন ঘটতে থাকে এবং এটা অনেক সময় সাইক্লোথাইমিয়ার সাথে আসে। এ রোগের উৎপত্তি খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং বংশানুক্রম এই দুটোরই বেশি প্রভাব দেখতে পেয়েছেন। হাইপোম্যানিয়া হলে তার অনেক লক্ষণ দেখা যায়। যার শুরুটা হয় মানসিক চাপ ও উদ্বেগ থেকে। এই মানসিক অবসাদই ধীরে ধীরে মানসিক বিকারে পরিনত হয়। কমে যায় নিজের প্রতি বিশ্বাস। কমে যায় নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। ফলে নিজেকে ব্যর্থ ভাবতে শুরু করেন রোগী। তাঁর মনে হয়, জীবনে সবকিছু হারিয়ে গেল, বেঁচে থাকাই অর্থহীন। এই ভাবনা থেকেই উৎকণ্ঠা, কম ঘুম এবং শেষে যে কোনও ভয়ানক পরিস্থিতি ঘটাতে পারে রোগী। অর্থাৎ আত্মহত্যার দিকে ধীরে ধীরে এগোতে থাকেন ওই রোগী। সুশান্ত সিং রাজপুতের চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট ডক্টর সুজান মোফাট ওয়াকার দাবি করেছেন, এই অভিনেতাও একই রোগের শিকার হয়েছিলেন।