- সাধারণত রাতের খাবারে ভাত বেঁচে গেলে অনেকেই তাতে জল মিশিয়ে রেখে দেন। যে পান্তা ভাত নামে পরিচিত। পরদিন সেই পান্তা কাঁচালঙ্গা, সর্ষের তেল ও পিয়াঁজ দিয়ে খেয়ে তৃপ্তি পাননি এমন বাঙালি পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু এই পান্তা ভাতে কি কোনও উপকারিতা আছে? নাকি ভাত নষ্ট হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতেই পান্তা করে খেয়ে নেন সকলে? কিন্তু গবেষণা বলছে পান্তা ভাতের উপকারিতা গরম ভাতের খেকেও বেশি।
সম্প্রতি মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া প্রতিযোগিতার ফাইনালে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মহিলা চৌধুরী পান্তা ভাত তৈরি করে সবাইকে চমকে দিয়েছেন। কেউ ভাবতেই পারেননি, এরকম এক প্রতিযোগিতায় পান্তা ভাত বানানো যায়। আর সেটা দেখে তাক লেগে গিয়েছিল বিশ্ববাসীর।
ওই বাংলাদেশি তরুণী প্রমান করে ছাড়েন যে পান্তা একেবারেই হেলাফেলা করার খাদ্য নয়, এর উপকারিতাও আছে যথেষ্ট। সম্প্রতি পান্তা ভাত নিয়ে গবেষণা করছেন অসম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি জৈব প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. মধুমিতা বড়ুয়া। তিনিই প্রথম প্রমান করেন পান্তা ভাতের উপকারিতা কতটা, আর খারাপ দিক আদৌ কম। আসুন জেনে নেওয়া যাক পান্তা ভাতের উপকারিতাগুলি।
আমরা জানি ভাতে বিশুদ্ধ পানীয় জল ঢেলে সারা রাত ভিজিয়ে রাখলে সেটা পান্তায় রূপান্তরিত হয়। মূলত যে সমস্ত এলাকায় আবহাওয়া অত্যন্ত গরম এবং আর্দ্র, সেখানে খুব সহজেই ভাত নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু সেই ভাত জলে ভিজিয়ে রাখার কারণে তা দ্রুত নষ্ট হয় না। ফলে ধরে নেওয়া যায় বেঁচে যাওয়া ভাত সংরক্ষণ করতে প্রাচীনকালে পান্তা ভাতের উৎপত্তি হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান গবেষণায় জানা যাচ্ছে এর গুণাবলী।
সারা রাত বা ১০-১২ ঘন্টা রেখে দেওয়ার ফলে জল ও ভাতের মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়। এসময় জলের নিচে থাকা ভাত বাতাসের অর্থাৎ অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসতে পারে না। আবার জলের কারণে ভাতের ফারমেন্টেশন বা গাজন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। এবং পাত্রের ভেতরে এনারোবিক ফারমেন্টেশনের ঘটনা ঘটে। আর এই প্রক্রিয়ায় ভাতের মধ্যে থাকা কার্বোহাইড্রেট ভেঙে যায়। যা সহজেই আমাদের শরীরে মিশে যেতে পারে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, পান্তা ভাতে নানা ধরনের মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা পুষ্টিকর খনিজ পদার্থ রয়েছে। সেগুলি হচ্ছে আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, জিঙ্ক, ভিটামিন বি ও ফসফরাসের মত উপাদান। এই খনিজ পদার্থগুলি সাধারণ ভাতের তুলনায় পান্তা ভাতে বেশি থাকে। কারণ সাধারণ ভাতের মধ্যে ফাইটেটের মতো যে এন্টি-নিউট্রিশনাল ফ্যাক্টর আছে তা আয়রন, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও জিঙ্কের মতো পুষ্টিকর পদার্থকে বেঁধে রাখে। কিন্তু জলের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে ফাইটেট দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তখন পুষ্টিকর পদার্থগুলো উন্মুক্ত হয়ে পড়ে এবং পান্তা ভাতে এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে যায়। গবেষক ডাঃ মধুমিতা বড়ুয়া জানিয়েছেন, ১০০ মিলিগ্রাম সাধারণ ভাতে যেখানে ক্যালসিয়াম থাকে ২১ মিলিগ্রাম, সেখানে পান্তা ভাতে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৫০ মিলিগ্রামে। আবার ১০০ মিলিগ্রাম সাধারণ ভাতে আয়রনের পরিমাণ থাকে ৩.৫ মিলিগ্রাম। কিন্তু ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে তৈরি করা পান্তা ভাতে এর পরিমাণ বেড়ে গিয়ে হয় ৭৩.৯ মিলিগ্রাম। ফলে ভাত খাওয়ার পরেও মানুষের শরীর এসব গ্রহণ করতে পারে না। কিন্তু ফারমেন্টেশনের কারণে পান্তা ভাতের খনিজগুন উন্মুক্ত হয়ে যায়, যা সহজেই আমাদের শরীর গ্রহণ করতে পারে। এই পুষ্টিকর পদার্থগুলি আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটিকে শক্তিশালী করে।
কিভাবে? আয়রন শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে, যা পান্তা ভাতে প্রচুর পরিমাণে থাকে। আমাদের শরীরে নিঃসৃত এনজাইমকে সক্রিয় করতে সাহায্য করে ম্যাগনেসিয়াম। আবার হাড় শক্ত করতে কাজে লাগে ক্যালসিয়াম। এছাড়াও গবেষণায় দেখা গেছে পান্তা ভাতে প্রচুর পরিমাণে বিটা-সিটোস্টেরল, কেম্পেস্টেরোলের মতো মেটাবলাইটস রয়েছে যা শরীরকে প্রদাহ যন্ত্রণা থেকে রক্ষা করে। আবার কোলেস্টোরেল কমাতেও পান্তা ভাতের উপাদান সাহায্য করে থাকে।
অপকারিতা কী কিছুই নেই?
- গবেষক ডাঃ মধুমিতা বড়ুয়া জানিয়েছেন, তাঁদের গবেষণায় পান্তা ভাতের কোনও ক্ষতিকর দিক এখনও উঠে আসেনি। তবে পান্তার জল যদি বিশুদ্ধ না হয় তবে তাতে বিষক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর ১২ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ভাতের ফারমেন্টেশন হলে সেখানে অ্যালকোহলের উপাদান বেশি তৈরি হয় এবং সেই পান্তা ভাত খাওয়ার পর শরীর ম্যাজ ম্যাজ করে ও ঘুম পেতে পারে। তবে তবে ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য এই খাবার ক্ষতিকর কীনা সেটা জানতে তারা এখনও কাজ করছেন।