বিজ্ঞান যত এগোচ্ছে সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে নানান জটিল রোগের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর সেই সমস্ত রোগের নিরাময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানও আধুনিক থেকে আধুনিকতর হয়ে উঠছে। অত্যন্ত জটিল রোগের মোকাবিলার জন্য নানান আধুনিক যন্ত্রপাতির আবিস্কার হয়েছে। রোগের সঙ্গে লড়াই করার জন্য বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় মাধ্যম হল আইসিউই (ICU)। কিন্তু অনেকেরই ধারণা এই আইসিউই-তে কোনও রোগীকে রাখা মানেই তাঁর প্রাণ সংশয়ে রয়েছে। এবিষয়ে বিস্তারিত জানালেন বিশিষ্ট চিকিৎসক -ডা: অয়ন মাইতিআ
ইসিউই কি এবং কেন?
আধুনিক অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসায় যে সমস্ত অত্যাধুনিক ওষুধ আবিস্কার হয়েছে সেগুলি মানুষের জীবন বাঁচাতে বর্তমানে যথেষ্টই কার্যকরি। কিন্তু মনে রাখতে হবে সময়টা এখন অনেক বেশি কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ও যন্ত্র নির্ভর। যেখানে মানুষের ভুল করার সম্ভবনা থাকে সেখানে যন্ত্র কাজ করবে নির্ভুলভাবে। যেমন ভেন্টিলেশন যন্ত্র যা করতে পারে মানুষের পক্ষে সেটা করা সম্ভব নয়। একটি ভেন্টিলেশন যন্ত্রে এমনভাবে ক্যালিবারেশন (Calibration) করা থাকে যে মানুষের শ্বাস প্রশ্বাসের প্রতিটি স্পন্দন সে নিখুদভাবে ধরতে পারে। খালি চোখে মানুষের বক্ষে সেটা ধরা অসম্ভব। একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টি একটু সহজ হয়ে যাবে। একজন রোগী মিনিটে ১০ থেকে ১২ বার শ্বাস নিচ্ছে। এই শ্বাস নেওয়ার সারাদিনের হিসেব নির্ভুলভাবে রাখতে পারে ভেন্টিলেশন যন্ত্র।
মিনিটে ১২ বার
ঘন্টায় ১২X৬০ বার
দিনে ১২X৬০X২৪ বার
এই হিসেব ক্রমাগত কষে যেতে থাকে ওই যন্ত্র, এরমধ্যে সামান্য অস্বাভাবিকতা ধরা পড়লেই অ্যালার্ম দিয়ে জানান দেবে ভেন্টিলেশন যন্ত্র। যা ওই ব্যক্তি বা রোগীর চিকিৎসায় খুবই জরুরী। সুতরাং রোগীর সামান্যতম সমস্যা দেখা দিলেই চিকিৎসকরা জানতে পারছেন, এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারছেন। তবে বেশকিছু জটিল (Critical) রোগের/রোগীর জন্য আইসিইউ-তে বেসিক কিছু মানদন্ড (Criteria) রয়েছে। যেমন,
১. নি:শ্বাস কমে যাওয়া
২. হৃদ স্পন্দনের সমস্যা
৩. রক্ত চাপের সমস্যা
৪. সুগার লেভেল ওঠা-নামা
৫. অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়া
৬. জ্বরের ক্ষেত্রে শরীরের তাপমাত্রা অত্যাধিক বেড়ে যাওয়া (১০৪-১০৬ ডিগ্রি)
সাধারণ ওয়ার্ডে একজন রোগীকে দিনে চারবার পর্যন্ত দেখা সম্ভব ডাক্তারবাবুদের। কিন্তু আইসিইউ-এর ক্ষেত্রে রোগীকে ঘন্টায় ঘন্টায় আবার কখনও প্রতি মুহুর্তেই দেখতে হয়। আইসিইউ-তে সাধারণত খুবই মরণাপন্ন (Critical) রোগীকেই রাখা হয়। তবুও তাঁর সুস্থতার ১০০ শতাংশ নিশ্চয়তা (Guarantee) দেওয়া সম্ভব নয়। তাই আইসিইউ সাধারণ মানুষের কাছে আজ একটা আতঙ্কের জায়গা। অনেকেরই ধারণা বা অভিযোগ, আইসিইউতে রেখে অনেক ক্ষেত্রে বিল বাড়িয়ে নেওয়া হয়। যদিও আদতে সবটা ঠিক নয়। কারণ একটা আইসিইউ ইউনিট চালাতে গেলে চিকিৎসা কেন্দ্রগুলির অনেকটাই খরচ হয়। প্রথমেই ধরা যাক একটি ভেন্টিলেশন যন্ত্রের দাম, বর্তমান সময়ে যার দাম দশ থেকে বারো লক্ষ টাকা। অর্থাৎ আইসিইউ ইউনিটের ভাড়া প্রতিদিন ২০০০ টাকা রাখা হলেও একটি যন্ত্রের দাম কতদিনে উঠবে? এছাড়াও রয়েছে ওষুধপত্রের দাম। সাধারণত যেহেতু আইসিইউতে জটিল রোগের চিকিৎসা হয় সেহেতু এখানে সাধারণ অ্যান্টিবায়টিকের থেকে বেশ দামী ওষুধ প্রয়োগ করতে হয় রোগীকে। সামান্য জ্বর, সর্দি-কাশি হলে যে অ্যান্টিবায়টিক দেওয়া হয় রোগীকে তার দাম ২০০-২৫০ টাকার মধ্যে হয়। কিন্তু আইসিইউতে চিকিৎসধীন রোগীর ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়টিকগুলির দাম দুই থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। ফলে সারাদিনে ১০-১২ হাজার টাকার ওষুধ প্রয়োগ করতে হয় একেকজন রোগীকে। এরসঙ্গে যুক্ত হয় ২৪ ঘন্টা দক্ষ কর্মী বা নার্স ও চিকিৎসকদের পারিশ্রমিকও।
আজ আমরা এমন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি যেখানে শরীরের প্রতিটি অঙ্গের জন্য আলাদা আলাদা করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। ফলে সবরকম জটিল রোগের জন্যই দরকার পড়ছে আইসিইউ। আর এই আইসিইউ অত্যন্ত খরচাসাপেক্ষ। তাই সেই সামর্থ না থাকলে সরকারি হাসপাতালের সাহায্য নেওয়া উচিৎ। কারণ বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিংহোমের খরচ অনেকটাই বেশি। মাঝারি মানের আইসিইউ-তেই খরচ দিনপ্রতি ২০-২৫ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। কোনও ক্ষেত্রে এই খরচ আরও বেশি হয়ে যেতে পারে। তবে কী কারোর টাকা-পয়সা কম থাকলে তাঁর চিকিৎসা হবেনা? উত্তর নিশ্চই করা সম্ভব, সেক্ষেত্রে মেডিক্লেম পলিশি করে রাখা যেতে পারে। তাছাড়া সরকারি হাসপাতাল তো রয়েছেই। বর্তমানে রাজ্যের অনেক মহকুমা ও জেলা হাসপাতালেও আইসিইউ পরিষেবা মিলছে।